খাপছাড়া বক্তব্য হলো গুজব!
গুজব হল আমেরিকান ইংরেজিতে rumor বা ব্রিটিশ ইংরেজিতে rumour; অর্থ হল- রটনা, জনরব ইত্যাদি। সাধারণত জনসাধারণের সম্পর্কিত যেকোন বিষয়, ঘটনা বা ব্যক্তি নিয়ে মুখে মুখে প্রচারিত কোন বর্ণনা বা গল্প। যেনম- এক ভদ্রমহিলা সন্তান প্রসব করেছেন। সন্তানটির গাঁয়ের রং কালো। তো মহিলার ননদ তার শশুর বাড়ীর লোকদের বলে যে, সন্তানটি কাকের মতো কালো হয়েছে দেখতে। এই সংবাদটি আবার তার শাশুরি উপস্থাপন করে যে, ঐ ভদ্রমহিলা কাক জন্মদান করেছেন। ইহাকে অনেক সময় রটনা, জনরব বা গুজব ছড়ানো বলে।
সামাজিক বিজ্ঞানের ভাষায়, গুজব হল এমন কোন বিবৃতি যার সত্যতা অল্প সময়ের মধ্যে অথবা কখনই নিশ্চত করা সম্ভব হয় না। অনেক পন্ডিতের মতে, গুজব হল প্রচারণার একটি উপসেট মাত্র। যদিও সমাজবিজ্ঞান এবং মনোবিজ্ঞান শাস্ত্রে গুজবের ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা পাওয়া যায়।
গুজব অনেক ক্ষেত্রে “ভুল তথ্য” এবং “অসঙ্গত তথ্য” এই দুই বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। “ভুল তথ্য” বলতে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্যকে বুঝায় এবং “অসঙ্গতি তথ্য” বলতে বুঝায় ইচ্ছাকৃতভাবে ভ্রান্ত তথ্য উপস্থাপন করা। তবে এ-ই ধরনের কার্যক্রম সাধারণত হলুদ মিডিয়া করে থাকে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে এমন গুজব বরাবর সংঘটিত হয়, সৈনিকদের মনোবল নষ্ট করার জন্য। শত্রু পক্ষ এই ধরনের রটনা বা গুজব ছড়িয়ে থাকে।
তবে আজকালকার ভার্চ্যুয়াল বা ডিজিটাল ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় প্রচলিত মতবিশ্বাসের ঊর্ধ্বে বহু গুজব ছড়িয়ে থাকে। যেমন, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব রটানো বা ছড়ানো রীতিমতো অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ডিজিটাল ইকোনমিতে বহু প্রতারক মিথ্যাচারের মাধ্যমে প্রতারণা করে। যেটাকে ব্রিটিশ ইকোনমিস্ট স্টিফেন ডি. লেভিট জনরব, রটনা বা গুজব বলে বলেছেন। এরকম বিশ্লেষণ তিনি তাঁর Freackonomics and super freackonomics গ্রন্থে বিশদ আলোচনা করেছেন। আর ঠকবাজি, প্রতারণা, জালিয়াতির ঘটনা ঘটে এই গুজবে বা জনরবে। খাপছাড়া বক্তব্য হলো গুজব। তবে খাপছাড়া বক্তব্য দ্রুত মাঠে, সমাজে ছড়িয়ে যায়।
রাজনীতিতে গুজব বরাবর একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। বিশেষত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রাজনীতিতে গুজব একটি মারাত্মক হাতিয়ার। এক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ সম্পর্কে ইতিবাজক গুজবের পরিবর্তে নেতিবাচক গুজব সর্বদা অধিক কার্য়কর হতে দেখা গেছে। আধুনিক পৃথিবীর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যেসব রাষ্ট্র পরিচালিত হয়ে থাকে, তার সবগুলো রাষ্ট্রে গুজব রীতিমতো কৌশল হিসেবে কাজে লাগিয়ে থাকে বিরোধী পক্ষ ও সরকার দলীয় দু’পক্ষই। এই আধুনিক পৃথিবীতে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাতেও গুজবকে অভিনব কৌশলে অবলম্বন করা হয়ে থাকে। সুতরাং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে গুজবকে কৌশল হিসেবে ব্যবহার হতে দেখা যাবে বা যাচ্ছে। তাতে অবাক হওয়ার বিশেষ কিছু নেই। বিশেষ করে যারা এই গুজব বা জনরব সম্পর্কিত তথ্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন, তারা অবাক হবেন না। এই রাষ্ট্রের স্বাধীনতার সময় গুজব রটিয়েছে। বিশেষ করে যারা স্বাধীনতা চাননি, তারা নিয়মিত গুজব রটিয়ে বেড়াইয়াছে। অবশ্য পরবর্তী সময়ে মুক্তিবাহিনীর পক্ষেও অনেক সময় গুজব ছড়ানো হয়েছে। যাতে পাক-হানাদার বাহিনী পিছু হটে। এমনকি রাজাকার আলবদর বাহিনীর লোকেরা মুক্তিবাহিনীর গুজবে পশ্চাদপসরণ করেছেও বটে। যখন সময়ের ব্যবধানে মুক্তিবাহিনীর জয়জয়কার সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এতো গেল যুদ্ধংদেহী মনোভাব সময়ের গুজব সম্পর্কিত তথ্য। কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী সময়েও বাংলাদেশের বিপক্ষে এবং বাংলাদেশের বাজার অর্থনীতির বিষয়ে নানা গুজব বা জনরব ছড়ানো হয়েছিল। যা পরবর্তীতে বিদ্বেষমূলক আচরণের অভিযোগ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। কথায় আছে, “আপনি আপনার শত্রুকে শায়েস্তা করতে পারেন একমাত্র গুজবের মাধ্যমে।” যেটা সরকারকে মোকাবেলা করতে হয়েছে সেই সময়। পরিশেষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জীবনের বিনিময় দিয়ে গুজবের ফলাফল উপভোগ করেছেন গুজব বা জনরব রটনাকারীরা। সেটা আজ ইতিহাস, অবশ্য বাঙালির কাছে দুঃখজনক ইতিহাস।
মুসলমানদের জন্য এপ্রিলফুল একটি গুজব। স্পেনের রাষ্ট্রীয় কৌশলে এ গুজব ছড়ানো হয়েছিল বলে জানা যায়। বিস্তারিত বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য ও বিশ্লেষণের বইয়ের মাধ্যমে পাওয়া যায়।
যাইহোক শিক্ষার ক্ষেত্রে গুজব ছড়ানো হয়েছিল এই বঙ্গরাষ্ট্রে। ইংরেজি ভাষায় বা ইংরেজিতে শিক্ষা গ্রহণে মুসলমানিত্বের ধ্বংস হবে বলে গুজব বা জনরব রটানো হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে বাঙলার মুসলমানরা সেটা বুঝতে পেরেছিলেন বটে। কিন্তু আধুনিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ততদিনে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষজন যথেষ্ট পিছিয়ে পড়েছিল। পরে তা বুঝতে পেরে ইংরেজি শিক্ষাসহ আধুনিক শিক্ষাতে মনোযোগী হতে থাকে বাঙালি মুসলিম।
গুজব যদি সরকার বিরোধী হয় বা সমাজ বিরোধী, জাতি বিরোধী, দেশ বিরোধী হয়, তাহলে সরকার সবার আগে বেকায়দায় পড়ে। সুতরাং সরকারকে বিচক্ষণতার সঙ্গেই মোকাবেলা করতে হয় গুজবকে। কেননা সবার আগে গুজববিরোধী হতে হয় সরকারকেই। সরকারকে যে কোন ধরণের ( যেমন, জনসচেতনতা সৃষ্টি, পরিস্কার ধারণা বা গুজব সম্পর্কিত বিষয়ে স্বচ্ছ জ্ঞান দান) পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয় গুজববিরোধী। আর এভাবেই অতীতে গুজববিরোধী সমাধান করার চেষ্টা করা হয়েছে এবং সফলকাম হয়েছেও বটে। রাষ্ট্র পরিচালনাতে যারা দায়িত্ব নিয়েছে, তাদের অপকর্ম বা দায়িত্ব অবহেলার জন্য সাধারণ নাগরিকগণ পদত্যাগ চাইতেই পারে। বিশেষত সামাজিক বিশৃঙ্খলা বেড়ে ওঠার জন্য দায়ীদের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়োজিতদের করতে হয়। না পারলে নাগরিকগণ পদত্যাগ চাইতে পারে। ইতোমধ্যে কিছু লোক সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন। বিশেষত গুজববিরোধী একটা সমাধানের জন্য। হতে পারে এটাও গুজব। তবে গুজববিরোধী একটা বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা সময়ের বিশেষ দাবীতে পরিণত হয়েছে।
রাশিদুল রাশেদ
কবি, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ।