সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়
ড. রেবা মন্ডল :
কোনো কাজ অপরাধ হয় যখন তা আইন বিরোধী হয়। হাজার রকমের অপরাধ প্রতিনিয়ত সমাজে ও রাষ্ট্রে ঘটে চলেছে। এছাড়া যে কোনো ক্রান্তিকালে নারী-শিশুরাই বেশি অপরাধের শিকার হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে কন্যা শিশুদের ওপর নির্যাতন অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে, যা অত্যন্ত হাতাশাজনক, আশংকাজনক, ভয়ানক ও বিভৎস। মাত্র কয়েক মাস পূর্বে টিভিতে দেখা গেল এক বখাটে মারধর করছে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে একটি মেয়েকে। উত্যক্ত করার প্রতিবাদে মা মেয়েসহ দুজনকেই জঘন্যভাবে পিটিয়ে জখম করে বখাটেরা। ঢাকার লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের রিশা, সিলেটের খাদিজা এরকম ঘটনা অহরহ ঘটছে। আর আমরা শুধু অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে আছি-কখন বন্ধ হবে এসব অপরাধ।
মানুষের অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায় বিবিধ কারণে। কারণগুলোর মধ্যে যেগুালো অন্যতম সেগুলো হল অসুস্থ বা বিকৃত মনস্তত্ব, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, অপরাধীর দ্রুত ও কার্যকরী বিচার না হওয়া, সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশের অভাব, সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার অভাব, সুস্থ বিনোদনের সুযোগ না থাকা, ধর্মীয় অপসংস্কৃতি সমাজে বাসা বাঁধা, ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসগুলোতে পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা। বিভিন্ন অপরাধ বিজ্ঞানী অপরাধের বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করেছেন। যেমন কার (Carr) বলেছেন অপরাধ প্রবণতা হল- “সমীকরণ বিদ্যা যেখানে মিলের চেয়ে বিচ্যুতি বেশী”।
আবার মার্ক্সের মতে, “দারিদ্র্য হতে হেয় নীতিজ্ঞানের জন্ম হয় ও দারিদ্র্য লোকেরাই বেশি অপরাধ প্রবণ হয়।” হারউইজ বলেছেন, “অপরাধের কারণগুলো অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষ্যম্যের ফলে সৃষ্টি হয়।” অপরাধ বিজ্ঞানী লম্বরোসো বলেছেন, “১৭ টি শারীরিরক বৈশিষ্ট্য (Physical symtom) রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে কারও দেহে কমপক্ষে ৫টি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকে তিনিই একজন অপরাধপ্রবণ মানুষ হয়ে থাকেন।” অপরাধের কারণ হিসেবে সামগ্রিকভাবে মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় অবস্থা, পারিপ্বার্শিক ও পারিবেশিক এবং মনোবৈজ্ঞানিক অবস্থাই দায়ী। এজন্যই ছোটবেলা থেকেই একটি গুরুত্বপূর্ণ ইংরেজি বাক্য যে, Life is not an accident but the result of environment. আর একারণেই হয়তো পরিবেশবাদী ওয়াটসন বলেছেন যে, তিনি যদি একটি শিশু পেতেন তবে যে রকম ইচ্ছা (ভাল বা মন্দ) মনের মতো করে গড়তেন, পূর্বপুরুষদের কোনও প্রতিভা, সামর্থ্য, বৃত্তি, জাতি যাই হোক না কেন তাতে কিছু যায় আসে না।
মানবসমাজের মধ্যে যখন মননশীল সংস্কৃতিচর্চার অভাব দেখা দেয় তখন অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়। খেলাধুলা, গান, বাজনা, সাহিত্য, নাচ, গান, আবৃত্তি, অভিনয়ের মতো বিষয়গুলো যখন সমাজ থেকে বিলুপ্ত হতে থাকে তখন অন্য কোনও বিনোদনের দিকে মানুষ বেশি ঝুঁকে পড়ে। আর বর্তমানে বিনোদন হিসেবে হাতের পাঁচ আঙুলের মধ্যে মোবাইলের মতো ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলোতে পর্নোগ্রাফির মতো দৃশ্যগুলো অবলোকন করে বেশিরভাগ উঠতি ছেলেরা। যার ফলে রুচি বিকৃতি ঘটে তাদের বেশি।
আমাদের সমাজে পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক কার্যকরী মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের কোন শিক্ষা ব্যবস্থা নেই। ধর্ম পুস্তকে নীতি-নৈতিকতার কথা লিখিত থাকলেও সত্যিকারের যোগ্য শিক্ষকের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যদানের কোন ব্যবস্থা নেই। আর পরিবারের বড়দের ও সমাজের বড়দের এখন আর ছোটবেলা থেকে একটি শিশুকে মূল্যবোধ বৃদ্ধি সংক্রান্ত কথাবার্তা আদেশ উপদেশ দেওয়ার রেওয়াজ কমে গেছে। অভিভাবকেরা শুধু অর্থনৈতিক উন্নতির কথা চিন্তা করে, ছেলের ভালো রেজাল্টের উপর গুরুত্ব প্রদান করে।
কিন্তু ভালো মানুষ হওয়া, বড়দের সম্মান করা, ছোটদের স্নেহ করা, শিক্ষককে সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া, পৃথিবীর কারও সাথেই খারাপ ব্যবহার না করা, সত্য কথা বলা, সৎ হওয়া, জোড় জবরদস্তি কারও প্রতি না করা, নিষ্ঠুর আচরণ না করা, রাগ, লোভ-লালসা দমন করা, কারও মালিকানা ও দখলে হস্তক্ষেপ না করা, কাজ ও দায়িত্বে অবহেলা না করা, যার যার কাজের প্রতি, দায়িত্বের প্রতি যৌক্তিক হওয়া, নারী ও শিশুসহ প্রতিটি মানুষের সাথে সুষম ও সুসভ্য আচরণ করা, প্রতিটি মানুষ প্রতিটি মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা প্রদান করা, কারও যুক্তি, মত ও দর্শনকে ধৈর্যের সাথে শোনা ও সম্মান প্রদর্শন করার অভ্যাসে গড়ে তোলার কোন শিক্ষা দেওযার সময় ও প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না। আর এসব বিভিন্ন কারণে দিন দিন মূল্যবোধ হ্রাস পাচ্ছে। সমাজে অপসংস্কৃতি বাঁসা বেঁধেছে।
আর দীর্ঘ বছর ধরে অপরাধের দ্রুত ও কার্যকরী বিচার হচ্ছে না। নারী ও শিশু হত্যা, নির্যাতন ঘটনার ক্ষেত্রে মামলা হলেও নিম্ন আদালত শাস্তির রায় দিলেও উচ্চতম আদালত বেকসুর খালাস পর্যন্ত দিয়ে দেয়। গত কয়েকমাস পূর্বে টিভিতে দেখাগেল ঢাকা সিটি কলেজের ছাত্রী হত্যার সব আসামি সুপ্রিম কোর্টে আপিল ডিভিশনে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত ও অন্যান্য সব আসামি খালাস পেয়ে গেছে। যদি কোন মামলা মিথ্যা হয় তাহলে জন সম্মুখে তা পরিষ্কার করে প্রকাশ করা যায় যা সভ্য জাতির একান্ত প্রত্যাশা। অন্যথায় বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা দিন দিন হারিয়ে যাবে। আর অপরাধীরা আরামে অপরাধ করেই যাবে। আর সর্বপরি সমাজের প্রভাব প্রতিপত্তির দম্ভে দাম্ভিকেরা অপরাধীদেরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে যা অপরাধের বিচার ও শাস্তি প্রদানের বিরুদ্ধে সংস্কৃতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা পালন করে।
উল্লেখ্য আমাদের দেশেতো আইন কম নেই, ২০০০ এর বেশি আইন রয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন সংশোধন আইন ২০০৩ এর (ট) ধারায় শিশু অর্থ অনধিক ১৬ বছর বয়সের কোন ব্যক্তি, এখানে সংশোধনী প্রয়োজন। ১৬ বছর নয়, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে ২১ বছরের কম বয়স্ক কন্যাকে শিশু হিসেবে গণ্য করা বিবেচ্য। কারণ মেডিক্যাল সাইন্স অনুযায়ী ২০ বছরের পূর্বে কন্যার দেহে বাচ্চা ধারণের হাড় তৈরি হয় না। আরও একটি বিশেষ সংশোধনী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সংশোধন করা অতীব প্রয়োজন। তাহলে ধর্ষণের শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড এবং সর্বনিম্ন যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড এবং এটি এখন সময়ের দাবি।
আর ধর্ষণের মতো জঘন্য বর্বরোচিত অপরাধের বিচার হওয়ার পর শাস্তি কার্যকর হবে প্রকাশ্য স্থানে ফাঁসির মঞ্চে। অপরাধীর উত্তারাধিকার সূত্রে যে সম্পত্তির অধিকারী হওয়ার কথা সে সম্পদ সরকারের কোষাগারে চলে যাবে। আমাদের দেশে নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে যে কোন অপরাধের ব্যাপারে সিনেমা, টিভিসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে জনসচেনতা সৃষ্টিমূলক প্রোগ্রাম করতে হবে। রাষ্ট্র ও জনসমাজকে একযোগে অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে। আর যদি অপরাধীকে শুধু গ্রেপ্তার করে বিচার না করে ছেড়ে দেওয়ার রেওয়াজ টেকসই হতে থাকে তাহলে কন্যাশিশুর মানবাধিকার ব্যাপকভাবে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে, যা রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় উন্নতির পথের বড় হুমকি।